আহমদ মতিউর রহমান
শ্রীলঙ্কায় আগামী ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি। গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচন দেশটির সংস্কারের ভাগ্য নির্ধারণ করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্য ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। স্মরণ করা যেতে পারে দেশটির এই নির্বাচনের প্রেক্ষাপট। তামিল বিদ্রোহীদের দমন করার পর দেশটিতে শান্তির সুবাতাস বয়ে চলছিল। বড় প্রতিবেশী ভারত ও এশিয়ার আরেক বড় শক্তি চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর উপর নজরদারি বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা যাই বলি না কেন তা করার চেষ্টা করেছে। সেই দোলাচলে দুলেছে শ্রীলংকা। সাবেক প্রেসিডেন্টরা এ দিক ওদিক দু দিকেই হেলেছেন। কিন্তু যুদ্ধের কাল পার হয়ে স্বাভাবিক সময়ে এসে দেশটি কোভিড পরবর্তী সময়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। এক পর্যায়ে দেশটি দেউলিয়া হয়ে যায়। ২০২২ সালে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কাজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রায়শূন্য, চীনের কাছে বড় অঙ্কের ঋণ, সর্বনিম্ন পর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল। এই পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের এপ্রিলে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে শ্রীলংকা। শ্রীলংকা সরকার বলেছে, এ অবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী করোনা পরিস্থিতি। এ ছাড়াও পর্যটন খাতের বিপর্যয়ও এ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে মারাত্মক ভূমিকা রেখেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। পরে তিনি পদত্যাগ করেন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে নতুন প্রেসিডেন্ট হন ৭৫ বছর বয়সী রনিল বিক্রমাসিংহে। তিনি এ বছরও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। ২০১৯ সালে পাঁচ বছরের জন্য শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন রাজাপক্ষে। বিশ্লেষকরা বলছেন, একের পর এক ভুল নীতি প্রণয়নের কারণে দেশে সংকট হয়েছে। তিনি ক্ষমতা হারানোর পর মেয়াদের বাকি সময় দায়িত্ব পালনের জন্য দেশটির পার্লামেন্ট বিক্রমাসিংহেকে নির্বাচিত করে। অর্থনীতিতে সঙ্কটে ডুবে থাকা দেশটি ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এমন সময় কে নির্বাচিত হয়ে অর্থনীতির হাল ধরবেন সেদিকে দৃষ্টি থাকবে সবার।
শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কার্যক্রম ও প্রচার অভিযান পূর্ণমাত্রায় চলছে। নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ৩৯ প্রার্থী। দুই জন কমে এখন ৩৭ জন প্রার্থী আছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল ছাড়াও অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রধান তিন জন হলেন বিরোধীদলীয় নেতা সামাগি জনা বালাওয়েগয়া-এসজেবির সজিথ প্রেমাদাসা, ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার- এনপিপি জোট ও জেভিপি নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েক এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে শ্রীলঙ্কা পডুজানা পেরামুনার নমল রাজাপাকসে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিলের দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) দ্বিধাবিভক্ত। এর ছোট অংশের নেতা তিনি। আর নির্বাচন করছেন নির্দল হিসেবে। ইউএনপির অপর বড় অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সজিথ প্রেমাদাসা ‘সঙ্গী জন বালাওয়েগায়া’ নামে। বিগত নির্বাচনে জয়ী গোটাবায়া রাজাপাকসে ৫২.২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এনডিএফের সজিথ প্রেমাদাসা পান ৪১.৯৯ শতাংশ ভোট। তৃতীয় স্থানে ছিলেন জেভিপি নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়কে। ভোটের হার ৩.১৬ শতাংশ। তবে এই নির্বাচনে আগের সেই ধারা বজায় থাকবে বলে মনে হচ্ছে না।
শ্রীলংকার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কিছুটা বলে নেয়া ভাল। শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রত্যক্ষ ভোটে হয়। যে প্রার্থী শতকরা ৫০ ভাগ বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনি বিজয়ী হবেন। কিন্তু কোনো প্রার্থীই যদি শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পান তাহলে সবচেয়ে বেশি ভোট যে দু’জন প্রার্থী পাবেন তাদের মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোট হবে। তাতে যিনি বেশি ভোট পাবেন তিনিই হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট। তিনি সরাসরি ভোটে পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন। আর দেশটির পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ২২৫। তাদের মধ্যে ১৯৬ জন সারা দেশের ২৫টি প্রশাসনিক জেলা থেকে সরাসরি ভোটে জিতে আসেন। বাকি ২৯ জন এমপি মনোনীত হয়ে আসেন- কোন দল কত ভোট পাচ্ছে, সেই অনুপাতের ভিত্তিতে। ১৯৮০-এর দশকে সরাসরি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকে “রান-অফ” ভোটের প্রয়োজন হয়েছে এমন উদাহরণ নেই। এ বছরের নির্বাচন ভিন্ন পরিস্থিতিতে হচ্ছে বিধায় সেই প্রথায় বদল ঘটে কি না সেটা এখন দেখার বিষয়।
কি হবে নির্বাচনে আর দেশবাসীই কি চাচ্ছেন? শ্রীলঙ্কার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেশ ও গোটা অঞ্চলে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক সংকটের পর এটি প্রথম নির্বাচন; এই প্রথম চার হেভিওয়েট প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবং এই প্রথম তামিল দলগুলো তাদের প্রার্থী দিয়েছে। আগামী নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় রেখে বলা যায়, অনেকটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। ২০২২ সালে শুরু হওয়া শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার পর এটি হবে প্রথম এই ধরনের নির্বাচন। এই সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল বাজেট ও বাণিজ্য ঘাটতি, ঋণের স্তূপ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মারাত্মক হ্রাসের মতো কাঠামোগত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির কারণে, যা অত্যাবশ্যক পণ্যের ঘাটতি ও অতিমাত্রার মূল্যস্ফীতির জন্ম দেয়। খাদ্য ও রেশনের জন্য দীর্ঘ লাইন, বিদ্যুতের ঘাটতি, বিদ্যুতের চড়া দাম, প্রতিশ্রুতি পূরণে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা প্রভৃতির সঙ্গে একটি ‘নতুন ব্যবস্থার’ দাবি দেশব্যাপী বিক্ষোভের দিকে নিয়ে যায়। যদিও আন্দোলনটি মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল, একাধিক জাযগায় হিংসা, সংঘর্ষ এবং অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গিয়েছিল। এর শেষ দিনগুলিতে বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকে পড়ে এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতত তাদের চাওয়া হলো পর্দার পেছন থেকে রাজাপক্ষেদের মদদে রনিল ও আমলাতন্ত্র যেভাবে দেশ চালাচ্ছে তা থেকে বের হওয়া। কিন্তু নির্বাচনে জনগণই একমাত্র পক্ষ নয়। ভারত এবং চীনও গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। যে বিষয়ে আগেই উল্লেখ করেছি। এ রকম বিদেশি শক্তিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর ব্যাপারে কতটা আগ্রহী, সেটি কারো অজানা নেই। তারা বলছেন, পাশের বড় প্রতিবেশী দেশটি জেভিপিকে ক্ষমতায় দেখতে না-ও চাইতে পারে। সে রকম ক্ষেত্রে তারা বরং বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিলকে সহায়তা করবে, যেমন করেছে গত দুই বছর। রনিল তার প্রতিদান দিতে কার্পণ্য করছেন না।
এদিকে কলম্বোভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ভবানী ফনসেকা বলেন, শ্রীলঙ্কার জন্য এই সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২৯০ কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে অর্থনীতিতে বিপর্যয় অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন বিক্রমাসিংহে। ২০২২ সালে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭০ শতাংশ। সেটি কমিয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়েছে বিক্রমাসিংহের সরকার। স্থানীয় মুদ্রা শক্তিশালী করার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও পুনর্গঠন করা হয়েছে। ২০২৪ সালে দেশটির অর্থনীতিতে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। তার ভাষায়, প্রতিপক্ষরা মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার (আইএমএফ) বেলআউট ঋণের শর্ত মানতে বিক্রমাসিংহের চালু করা সংস্কার নীতির বিরোধিতা করবেন। দেশটি অর্থনৈতিক মন্দা থেকে খানিকটা ঘুরে দাঁড়ালেও এখনো প্রবৃদ্ধি আগের পর্যায়ে ফেরেনি এবং দেশের মানুষ জীবনযাপনের ক্রমবর্ধমান খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে এই বিশ্লেষক ভোটারদের অসন্তষ্টির কথাই বলছেন। এর ফল ভোটে পড়তেই পারে।
২০২৩ সালে বিক্রমাসিংহে আইএমএফ থেকে ২৯০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার জন্য যেসব শর্তে রাজি হয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে নতুন করে দরকষাকষি করার অঙ্গীকার জানিয়েছে বিরোধী দলগুলো। নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনৈতিক সংস্কারের অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। ২০২২ সালে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। সে বছর শ্রীলঙ্কার জিডিপি এর আগের বছরের তুলনায় সাত দশমিক আট শতাংশ কমে গিয়েছিল। যদিও ভারত শ্রীলঙ্কাকে তার অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে সহায়তা করেছে, দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। মানুষ একটি ‘ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের’ আহ্বান অব্যাহত রেখেছেন । শ্রীলঙ্কার আমন্ত্রণে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের জুনে শ্রীলঙ্কা সফরের সময়েও তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠক হয়েছে। এই ভাবে দলনিরপেক্ষ পথে ভারত নির্বাচনী ফলাফল থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ ও বিস্ময়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সংযোগ ও অর্থনৈতিক একীকরণের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চাপ রয়েছে। বন্দরের ক্ষেত্রে ভারত কলম্বো বন্দরে ওয়েস্ট কন্টেনার টার্মিনালে, জাফনার কাঙ্কেসান্থুরাই বন্দর ও ত্রিঙ্কোমালি বন্দরে সাহায্য করছে। এটি জাফনা বিমানবন্দরে সহায়তা করছে এবং হাম্বানটোটা বিমানবন্দর পরিচালনা করছে। শক্তি সহযোগিতার ক্ষেত্রে মান্নার ও পুনেরিনে বায়ু প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে, সামপুরে একটি সৌর প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে এবং ত্রিঙ্কোমালিতে তেল শোধনাগারগুলোকে আপগ্রেড করা হচ্ছে। একইভাবে একটি এনার্জি গ্রিড, একটি দ্বিমুখী পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন, একটি স্থল সেতু এবং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি (ইটিসিএ) নিয়ে আলোচনা চলছে। ভারতীয় সংস্থাগুলোও শ্রীলঙ্কার পাবলিক এন্টারপ্রাইজগুলিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ভারত থেকে সংযোগের জন্য এই চাপের লক্ষ্য শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে পুনরুদ্ধার করা এবং চীনা উপস্থিতি ও প্রভাব মোকাবিলা করা। যাই হোক, ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রায়ই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদী অনুভূতির বিষয় হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীরা কিছু ভারতীয় প্রকল্পের সমালোচনা করছে, এবং সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে সম্পদ বিক্রির অভিযোগ করছে। দুর্নীতির অভিযোগের কারণে কিছু প্রকল্প ইতিমধ্যেই ধীরগতি হয়ে পড়েছে এবং সরকারে পরিবর্তন হলে চুক্তি প্রত্যাহার করা হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী ভারতবিরোধী মনোভাব জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি সংযোগ, বিদেশী বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক একীকরণের জন্য ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। নির্বাচনে যেই জিতুক না কেন, ভারতের তরফে চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধির আশঙ্কা অব্যাহত থাকবে। চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব কলম্বোকে চীনের স্বার্থ ও কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫-২০১৯-এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছিল মোট ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, কিন্তু ২০০৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চিনের কাছে শ্রীলঙ্কার ঋণ ০.৪৫ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছিল। এমনকি আজও দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছে শ্রীলঙ্কার মোট ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে চীনের কাছে ঋণের পরিমাণ ৪.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপরে, এবং চীনই সর্বোচ্চ ঋণদাতা। এই হিসাবটিতে বাণিজ্যিক ঋণের ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধরা হয়নি। তার অর্থনৈতিক আধিপত্যের পরিপ্রেক্ষিতে, চীন শ্রীলঙ্কায় বন্দর ইজারা দেওয়া, পরিকাঠামো প্রকল্পের প্রসার, গুপ্তচর জাহাজ ও সাবমেরিন ডকিং এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে অস্ত্র তৈরির চেষ্টাসহ ভারতের বিরুদ্ধে তার প্রভাব ব্যবহার করে চলেছে এবং তা চালিয়ে যাবে। জেলেদের নিয়ে বিরোধ, ১৩তম সংশোধনী, সংযোগ প্রকল্প, বিতর্কিত অঞ্চল এবং এই অঞ্চলে চীনা প্রবেশের মতো বিষয়গুলি ভারতের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
আর চীনও চাইবে তার আগের অবস্থান ফিরে পেতে। শ্রীলঙ্কার ২০২২ সালের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী করা হয় চীনকে। এ কারণগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সম্পর্কে বিশ্লেষকেরা একমত হলেও চীনের অর্থায়নে মেগা প্রকল্পের ভূমিকা কতটুকু সেটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণে চীনা ঋণের হিস্যা যেহেতু ১৫ শতাংশ (তর্ক সাপেক্ষে), তাই শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য চীনা ঋণকে দায়ী করা ঠিক হবে না। ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার সংকট আসলে একটা উপসর্গ, মূল রোগ নয়। এটা মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসার আগেই ছিল।
মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসার আগেই শ্রীলঙ্কায় ঋণ জিডিপির অনুপাত ছিল ৮০ শতাংশ। চীনা ঋণ নিয়ে সমালোচনার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সেগুলো ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে এমন সব প্রকল্প, যেগুলো তৈরির আগেই স্পষ্ট ছিল সেগুলোর আদৌ কোনো অর্থনৈতিক উপযোগিতা নেই। হামবানটোটা সমুদ্রবন্দর, মাত্তালা রাজাপক্ষে বিমানবন্দর, কনফারেন্স সেন্টার এবং ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পোর্ট সিটি কলম্বোর কথা সবাই জানেন। শ্রীলংকা দেউলিয়া হবার পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়েছে। আর বিগত দেড় বছরে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকা। সেই ধারা অব্যাহত রাখতে সঠিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। ভোটাররা সেই পথে দেশকে এগিয়ে নিতে সঠিক নেতৃত্ব বেছে নেবে বলে সবার ধারণা।