আমরা ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। তবে এই মাছ যেন আমাদের প্রাণনাশের কারণ না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। এ কথা কেন বলছি? তা হলে একটু পেছনের দিকে যদি তাকাই, তা হলে দেখতে পাব-নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে পাওয়া পটকা মাছ রান্না করে খেয়ে ছেলেসহ মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
খুলনার লবণচরা থানার মাথাভাঙ্গা রেলব্রিজ এলাকায় গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এমন ঘটনা ঘটে। এমনকি ২০২০ সালে পটকা মাছ খেয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এক পরিবারের দুজন মারা যান। তারও আগে ২০১৫ সালে সিলেটের জৈন্তাপুরেও একইভাবে পটকা মাছ খেয়ে মারা যান পাঁচজন। এমন ঘটনা মাঝেমধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। প্রতি বছরই পটকা মাছ খেয়ে মানুষের মৃত্যু হয়।
সঠিক পরিসংখ্যান বা গবেষণা থাকলে হয়তো আসল সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হতো। গণমাধ্যমে যেসব মৃত্যুর খবর প্রকাশ হয়, তার বাইরে আরও মৃত্যুর ঘটনা থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও মানুষের মধ্যে বাড়েনি সচেতনতা। সেটি হয়তো প্রচার-প্রচারণার অভাবেও হতে পারে। দেশে রাক্ষুষে মাছ ‘পিরানহা’ এবং বিষাক্ত ‘সাকার’ মাছ নিষিদ্ধ করা হলেও পটকা মাছ এখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে সহজলভ্য এই মাছ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
পটকা মাছ বাংলাদেশের নদীতে সহজলভ্য। কোনো কোনো অঞ্চলে এর নাম ‘বেলুন মাছ’। এ ছাড়া পটকা মাছের চারটি বৈজ্ঞানিক নামও আছে। যথা-টেট্রোডন প্যাটোকা, শেলোনোডন প্যাটোকা, টেট্রোডন ডিসুটিডেনস এবং টেট্রোডন কাপ্পা। স্বগোত্রীয় টেপা মাছের বৈজ্ঞানিক নাম টেট্রাডন কুটকুটিয়া।
পটকা মাছ জাপানে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সে দেশে দামি, সুস্বাদু ও অভিজাত শ্রেণির মাছ হিসেবে এর আলাদা কদর আছে। এ মাছ তাদের ঐতিহ্যের অংশ। তবে সব দেশেই এটি গাঙ্গেয় জলজ প্রাণী হিসেবেই পরিচিত। যা ইংরেজিতে ‘ব্লো ফিশ’ বা ‘বেলুন মাছ’ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘পটকা’ বা ‘টেপা’ মাছ। দেখতে শান্ত প্রকৃতির হলেও মাছটি অনেক বিষাক্ত। সমুদ্রে এ মাছ খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে মাঝেমধ্যে জেলেদের জালে ধরা পড়ে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে পটকা মাছের ১৩টি প্রজাতি আছে। যার দুটি মিঠা পানিতে এবং বাকিগুলো সমুদ্রে বাস করে। এ মাছ সম্পর্কে জেলেদের কোনো ধারণা না থাকায় তারা নিজেরা এ মাছ খান অথবা অর্থের জন্য বাজারে বিক্রি করেন। বিষাক্ত এ মাছ খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা মারা যায়। তবে সব পটকা মাছই বিষাক্ত নয়। কিছু আছে যেগুলো হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বিষাক্ত। যদিও প্রত্যেক প্রজাতির পটকা মাছের বিষের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদন বাংলাদেশে নেই।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পটকা মাছ বিষাক্ত হওয়ার কারণ এর মধ্যে ‘টেট্রোডোটক্সিন’ নামে এক বিবশকারী বিষ থাকে। এ বিষ কারও শরীরে প্রবেশ করলে মৃত্যু অবধারিত। সেল মেমব্রেনের সোডিয়াম চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে তাড়াতাড়ি মৃত্যু ঘটাতে পারে। মাছের বিষাক্ত পদার্থটি তার যকৃৎ, ডিম্বাশয়, অন্ত্র এবং চামড়ার মধ্যে বেশি ঘনীভূত থাকে। তবে শরীরের পেশিগুলো সাধারণত বিষমুক্ত থাকে।
মৎস্যবিজ্ঞানীরা জানান, পটকার শরীরে প্রথম অবস্থায় কোনো বিষ থাকে না। পটকা সর্বভুক প্রাণী। খাদ্য শিকারের মাধ্যমে পটকার দেহে ধীরে ধীরে বিষ প্রবেশ করে। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। পরে তা পটকার দেহের বিভিন্ন অংশে জমা হয়। এ বিষে পটকা আক্রান্ত না হলেও বিভিন্ন রাক্ষুসে প্রাণীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব বিষ নিঃসরণ করে।
মাছের বিষের পরিমাণ নির্ভর করে এর লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং মৌসুমের ওপর। প্রজননের অব্যবহিত পূর্বে এবং প্রজননকালীন এতে অপেক্ষাকৃত বেশি বিষ থাকে। পুরুষ থেকে স্ত্রীজাতীয় মাছ বেশি বিষাক্ত হয়। কারণ অ-কোষ থেকে ডিম্বাশয় বেশি বিষাক্ত। পটকা মাছের বিষক্রিয়া সবার ক্ষেত্রে সমান নয়।
কারও প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকতে পারে, আবার কারও কম থাকতে পারে। সে হিসেবে পটকা মাছ খাওয়ার ২০ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হতে পারে। পটকা মাছ খাওয়ার পরপর নিচের উপসর্গগুলো দেখে বোঝা যায়, তিনি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন কি না-বিষক্রিয়ায় বমি হতে পারে বা বমি বমি ভাব হতে পারে।
মাথা ঘোরানো, মাথাব্যথা ও আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা বেড়ে যাবে। তলপেটে ব্যথা ও ডায়রিয়া হতে পারে। শরীর অসাড় হয়ে পড়া। হাত ও পায়ের পেশি দুর্বল হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। হাঁটা-চলার অক্ষমতা ও স্বাভাবিক চিন্তা প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে পারে। জিহ্বা এবং ঠোঁটের স্বাদ নেওয়ার ক্ষমতা লোপ পেতে পারে। এতে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ কমে যায়। অসাড় হয়ে যাওয়ার ফলে শ^াসতন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগী মারা যান।
তবে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার বেশি যে জীবিত থাকে; সে সাধারণত বেঁচে যায়। একটি মাঝারি আকারের জাপানি পটকায় যে টেট্রোডোটক্সিন থাকে, তা ৩০ জনেরও বেশি লোকের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পটকা মাছের বিষক্রিয়ায় মানুষ মারা যায়-খবরটি জাতীয়ভাবে প্রচার করতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় তা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
তাই এ মাছ খাওয়া বর্জন করাই সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। তবে যদি কোনো কারণে কেউ মাছটি খেয়ে ফেলেন এবং তার বিষক্রিয়া শুরু হয়, তা হলে নিম্নোক্ত উপায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারেন-যেকোনো উপায়ে বমি করানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। যাতে বমি আসে এবং ভক্ষণ করা মাছ বা বিষ বের হয়ে আসে। কাঠ-কয়লা গুঁড়ো করে সরাসরি অথবা পানিতে গুলে খাওয়াতে হবে।
কাঠ-কয়লা গুঁড়ো আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত বিষক্রিয়া নিরাময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ্য। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করাতে হবে, যাতে বিষক্রিয়ার ফলাফল কমে আসে। চেষ্টা করতে হবে জ্ঞান রাখার, কারণ জ্ঞান হারালে মস্তিষ্ক প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। ভর্তির পর অবশ্যই রোগীকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হবে।
পাশাপাশি পারিবারিক ও সামজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় বাজারে পটকা মাছ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। পটকা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ বিষয়ে জেলেদের সতর্ক এবং সচেতন করতে হবে। নদী, খাল, পুকুর বা বিলে মাছ ধরার সময় পটকা মাছ পেলে পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। বাজারে বিক্রি বন্ধ করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন সাকার মাছ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হলে জেলে ও বিক্রেতারা একসময় মাছটি বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য হবে। ফলে আমরা পটকা মাছ কিনব না, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরব না। মনে রাখতে হবে, জলজপ্রাণি হলেই তাকে মাছ হিসেবে খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
জাপানে পটকা মাছ খুবই জনপ্রিয়। তবে তারা রান্না করার আগে এ মাছ থেকে বিশেষভাবে বিষ আলাদা করে নেয়। তবে সে প্রযুক্তি এখনও আসেনি বাংলাদেশে। তাই এ মাছের বিষক্রিয়া থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে তা না খাওয়া। মৌলভীবাজারের মৎস্য বিভাগের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘মানুষ এ মাছ সম্পর্কে জানে না বলেই খায়। আর সে কারণেই মারা যায়।’ তাই আগে আমরা সচেতন হই। আমাদের পরিবারকে নিরাপদ রাখি। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতনতার বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।