ছাত্র রাজনীতি কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ছাত্রদের অধিকার, সুবিধা এবং সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফরম। ছাত্ররা যখন হলের সিট ভাড়া কমানো, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন হ্রাস করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে, তখন তাদের কণ্ঠস্বরটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রশাসনের কাছে এই দাবিগুলো তুলে ধরার জন্য ছাত্র নেতাদের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। সক্রিয় ছাত্র নেতারা কেবল দাবি জানায় না, বরং সংগঠিতভাবে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়, যা শিক্ষার্থীদের অধিকারের সুরক্ষা ও তাদের শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে সাহায্য করে। ছাত্র রাজনীতির এই দিকটি নিশ্চিত করে যে শিক্ষার্থীরা শুধু নিজেদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছে না, বরং সমাজের বৃহত্তর পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবেও কাজ করছে। সুতরাং, ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে ছাত্রদের কণ্ঠস্বর শোনা ও তাদের স্বার্থ রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।
ছাত্র রাজনীতি বর্তমানে ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে; অনেকেই এটিকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী হওয়ার বিষয় হিসেবে ভাবেন, অথচ প্রকৃতপক্ষে এটি ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষার একটি প্রক্রিয়া। এই ভুল ধারণার ফলে ছাত্র সমাজে চাটুকারিতা ও গ্রুপিংয়ের প্রবণতা বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যদি ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকে, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে এবং সমাজের উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত হবে। মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে দেয়ার প্রয়োজন নেই; বরং সমস্যার সমাধানে সক্রিয় হতে হবে এবং সঠিকভাবে নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। ছাত্র রাজনীতি যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তবে এটি দেশের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। সুতরাং, ছাত্রদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা নিজেদের অধিকার রক্ষা করার পাশাপাশি দেশ ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ছাত্ররা যখন গণতান্ত্রিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে, তখন তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল এক অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। জার্মানি-অস্ট্রিয়া, আর্জেন্টিনা, ভেনিজুয়েলা, কোরিয়া, দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও বলিভিয়ায় ছাত্রদের আন্দোলন ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তনের জন্য অগ্রণী। আমাদের দেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা ছিল অগ্রগামী শক্তি। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়, সর্বশেষ ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ছাত্ররা আবারো সামনের সারিতে এসেছে, যখন তারা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ছাত্রদের নির্ভীকতা ও সাহসী পদক্ষেপ আমাদের নতুন করে উদ্দীপ্ত করেছে, যেন তাদের মধ্যে লড়াইয়ের আগুন আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। ছাত্র রাজনীতি মানে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের জন্য লড়াই করা নয়; এটি হলো নিজেদের অধিকার চাওয়া এবং নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম করা। ছাত্রদের এই আন্দোলনই প্রমাণ করে যে, পরিবর্তন আনতে চাইলে তাদের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। ছাত্রদের এই আত্মবিশ্বাস ও প্রতিরোধ দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং, ছাত্র রাজনীতি শুধুমাত্র একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি দেশের অগ্রগতির পক্ষে একটি শক্তিশালী অস্ত্র।
ছাত্রদের মধ্যে কিছু খারাপ কাজ যেমন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি নিয়ে সমাজের দৃষ্টি কেন কেবল ছাত্র রাজনীতির প্রতি? যুবকদের মধ্যে একই ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম ঘটে, কিন্তু কেন ছাত্র রাজনীতির ওপর অধিক চাপ? কারণ, যখন ছাত্ররা সংগঠিত হয়, তখন তারা নিজেদের অধিকার ও স্বার্থের জন্য লড়াই করতে সক্ষম হয়, যা সামাজিক পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এই সংগঠিত ছাত্র সমাজের শক্তি নেতাদের জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তারা পরিবর্তনের পথে যাত্রা করলে অনেক বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ছাত্ররা যখন নিজেদের স্বার্থে সংগঠিত হয়, তখন তারা সৎ এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে, যা বিদ্যমান ক্ষমতাবলয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই নেতাদের চাপে রাখতে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এবং নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা হয়, যাতে ছাত্রদের এই শক্তি ও ঐক্যকে নিঃশেষ করা যায়। ছাত্রদের সংগঠনের ক্ষমতা সমাজের জন্য একটি আশার আলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যা কিছু মানুষের স্বার্থে বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হতে পারে।
ছাত্র রাজনীতির অবক্ষয়ের একটি বড় কারণ হলো নেতাদের প্রতি অন্ধ অনুসরণ এবং বিপক্ষ দলের প্রতি বিরূপ মনোভাব। রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব এবং সমালোচনার সুযোগের অভাব আমাদের ছাত্র সমাজকে একরোখা করে দিয়েছে, যা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সংকুচিত করেছে। যদি শুধুমাত্র মেধাবীরা বা ভালো রেজাল্ট করা ছাত্ররা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে, তবে তা রাজনীতির সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি একধরনের স্বার্থবাদী সংস্কৃতি তৈরি করবে। সঠিকভাবে রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হলে রাজনীতি সকলের জন্য উন্মুক্ত হওয়া জরুরি; অর্থাৎ, ছাত্র সমাজের সব স্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তদুপরি, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দলের চেয়ে দেশ বড়। এই ধারণা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারলে, ছাত্র রাজনীতি আরও শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গতিশীল হতে পারে। যখন ছাত্ররা নিজেদের স্বার্থের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করবে, তখনই প্রকৃত পরিবর্তন আসবে, যা দেশের ভবিষ্যৎকে আরও আলোকিত করে তুলবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সম্মান থাকা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি একটি স্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে। রাজনীতিতে সমালোচনা ও প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক, কিন্তু এই প্রতিযোগিতা যদি বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে ওঠে, তবে তা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। সম্মানের ভিত্তিতে আলোচনা ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দিতে শিখবে, যা একটি ইতিবাচক ও নির্মল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। এতে করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব প্রসারিত হবে এবং বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের মধ্যে সংলাপের সুযোগ তৈরি হবে। যখন রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতা, তখন তা জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। সুতরাং, রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্মান এবং আলোচনার ভিত্তিতে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা সমাজের জন্য একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে।
দোষ শুধু বড়দের নয়; ছাত্রদের মধ্যেও কিছু দোষ রয়েছে, যা মেনে নেয়া প্রয়োজন। ছাত্র সমাজের মধ্যে নিজেদের স্বার্থ এবং নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দেখা দেয়। কবিতায় বলা হয়েছে, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পরিবর্তন আনার দায়িত্ব আমাদের ওপরই। আমাদের বিচার-বুদ্ধি এবং বিবেককে জাগ্রত করতে হবে; অন্যথায়, চলমান পরিস্থিতির মধ্যে আমরা মুখ থুবড়ে পড়বো। যদি ছাত্র নেতারা ধর্ষণ বা হত্যা মামলার আসামি হন, কিংবা টেন্ডারবাজির মতো অপরাধে লিপ্ত থাকেন, তাহলে তারা রাজনৈতিক মাঠে ভালো ছেলেদের আসতে বাধা দেবেন। ছাত্র রাজনীতিতে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে হলে, ভালো ছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ দিতে হবে। যখন মেধাবীরা এবং সৎ মানুষ রাজনীতিতে যুক্ত হবে, তখন ছাত্র রাজনীতি কেবল একটি দলের দখলে থাকবে না; বরং তা একটি সুস্থ পরিবেশে রূপান্তরিত হবে, যেখানে সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব। তাই, আমাদের দোষ চাপানো কিংবা বড়দের রাজনীতি বন্ধের কথা ভাবার পরিবর্তে নিজেদের দিকে তাকিয়ে সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য সচেতন হতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই চান না ছাত্র রাজনীতি ভালো পর্যায়ে আসুক, কারণ এর ফলে তাদের অসৎ উপায়ে উপার্জন ও চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ছাত্ররা হচ্ছে নির্মল আত্মার অধিকারী, যাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে; তাদের মাঝে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আবেগটুকু জাগিয়ে দেয়ার প্রয়োজন। কিন্তু এই পরিবর্তন আনার দায়িত্ব কে নেবে? একই নেতা একাধিক গ্রুপকে লালন-পালন করছেন এবং গোপনে সব গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, যা ছাত্র সমাজকে বিভক্ত করে। অনেকেই বলেন, ছাত্র রাজনীতি ভালো ছেলেরা করে না, কিন্তু এটি পুরোপুরি সত্য নয়। ভালো ছেলেরা রাজনীতিতে আসলেও, তারা টিকতে পারছেন না, কারণ খারাপের সংখ্যা বেশি। নেতারা সাধারণত যোগ্যদের নেতৃত্বে আনার পরিবর্তে তাদের পছন্দের এবং আনুগত্যশীল লোকদের পদ দেন, যারা শুধুমাত্র তাদের গুণগান গায়। ফলে, প্রকৃত ভালো ছাত্রদের রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হচ্ছে, যা ছাত্র রাজনীতির মান এবং উদ্দেশ্যকে খর্ব করে। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে সৎ এবং মেধাবী ছাত্ররা নেতৃত্বে আসতে পারে এবং ছাত্র রাজনীতি একটি সৎ ও কার্যকর প্ল্যাটফরম হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
বর্তমান সময়ে ছাত্রদের ওপর চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও আন্দোলনের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করছে। তবে, ছাত্র রাজনীতি যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তাহলে এটি শুধু ছাত্রদের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। ছাত্র সমাজের মধ্যে যদি আদর্শ ও নীতির ভিত্তিতে কাজ করার তাগিদ তৈরি হয়, তাহলে তারা নিজেদের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হবে এবং সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে। পরিবর্তনের জন্য ছাত্র সমাজকে জাগ্রত হতে হবে, নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা ও সংহতি গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করলে তারা যেকোনো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারবে। সুতরাং, ছাত্র রাজনীতি এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে, যা একটি উন্নত, ন্যায্য এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের পথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। ডেইলি কাগজ’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- ডেইলি কাগজ কর্তৃপক্ষের নয়।